রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ (1956-1991) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কবি, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মী। তিনি ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু পরে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশের ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন, যেখানে তিনি 1970-এর দশকের ছাত্র রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
শহীদুল্লাহর কবিতা তার সাহসী এবং বিপ্লবী বিষয়বস্তুর জন্য পরিচিত, এবং তাকে প্রায়শই প্রতিরোধের কবি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর কাজগুলি তাঁর সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
তার কিছু বিখ্যাত কাজের মধ্যে রয়েছে “ভাঙ্গার গান” (ধ্বংসের গান), “কবর” (কবর), “একাত্তরের ডিঙ্গুলী” (৭১ এর দিনগুলি), এবং “জন্ম আমার ধোঁনো হলো” (আমার জন্ম বৃথা ছিল না) . তার কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ব্যাপকভাবে সংকলিত হয়েছে।
শহীদুল্লাহ ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে রয়ে গেছেন এবং নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ উক্তি
যাই বললেই সব কথা শেষ, যাই বললেই শুরু
যাই বললেই পথ আরম্ভ চলার প্রস্তুতি।
পেছন থেকে তুমি পুরোনো প্রেমের স্বরে
ডাকলেও আমি তাকাবো না আর ভালোবাসা
যেহেতু সভ্যতা আমাকে খেয়েছে এতোদিন
এবার আমি সভ্যতাকে খাবো।
শেষমেশ যে যার সন্ধার কাছে ফিরে যায়,
যে যার অন্ধকারের কাছে ।
আকাল- তবু স্বপ্ন থাকে
বিরোধ- তবু স্বপ্ন থাকে
ভাঙন- তবু স্বপ্ন থাকে
এবং জন্ম মানেই মৃত্যুর প্রতি অমােঘ যাত্রা
কবিতার কতোখানি বিশালতা দেখেছো তুমি
যে পায় সে পেয়ে যায় – বাকিরা হারায়।
শহরের সমস্ত রাস্তায় তোমাকে খুঁজেছি।
দুচোখে মৃত্যু মেখে যতোই অচেনা হও
কথার কৌশলে সাজিয়ে রাখো অপরিচিত অভ্যাস
তবু কতোটুকু অচেনা হবে!
নিরুপায় আমাকে তোমার স্নেহের করাতে
করেছো রক্তাক্ত।
স্বপ্ন ডুবিয়ে নির্ভার হতে চেয়ে
ডুবছি এখন স্বপ্নের বোঝা ব’য়ে
তেমন দূরেত্বেই থেকে যেও-
এক ইঞ্চিতেও কভু বলতে পারবে না কেউ
কতটা কাছা কাছি এসেছিলে বলে দূরত্বের পরিমাপ দিতে পারেনি পৃথিবী।
হে কিশোরী বুকের ভেতর
কতোটুকু বিষ রেখেছো আড়াল কোরে
সোনালী ঐ প্রেমের পাশে !
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয় ,
বিচ্ছেদ নয় ,
চলে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্নকরা আর্দ্র রজনী ।
চলে গেলে আমারো অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না থাকা জুড়ে
একা থাকার এই ভালো লাগায় হারিয়ে গিয়েছি,
নিঃসঙ্গতা আমাকে আর পাবে না
যতো দূরে ইচ্ছে হয় যাও,
বিশ্বাসী স্বপ্নের কাছে জেনে নেবো সঠিক ঠিকানা ।
তোমাকে জিততে হবে
মনে রেখো ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে!
উচিত ছিলো তোমার বাড়ি এক্কেবারে
আমার বাড়ির পাশেই হওয়া । জানলা খুলে
চোখ দুটোকে মেলে দিলেই দেখতে পাবো
টুকিটাকি জিনিশপত্র শোবার ঘরে
অলস চুলে বোলাচ্ছ সেই স্নিগ্ধ লাজুক
আঙুলগুলো । উচিত ছিলো জানলা খুললে
তোমার আমার দেখতে পাওয়া সারাটি ক্ষন।
যে পায় সে পেয়ে যাবে – আমার হবে না,
রবে না জলের চিহ্ন রোদের কপালে।
আমি শুধু চাষ হবো, হবো না ফসল?
বনভূমি কেটে শুধু নগর বানাবো?
স্মৃতিগুলো ডাস্টবিনের জঞ্জাল
আর আমিই অনুসন্ধানরত
আজীবন ডাস্টবিনের ব্যর্থ কাক।
প্রেমের নিকট গিয়ে ফিরে আসি – বুকে ভালোবাসা নেই।
কাকে বলো? অভিমান কার সাথে তবে?
অমনই হবে, হয়, ভেঙে তছনছ
পুড়ে পুড়ে খাক হও বিষন্ন অঙ্গার
কিছুই পাবে না তবু –
যে পায় সে পেয়ে যায় – বাকিরা হারায়।
সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি
সহজে থাকিনা কাছে,
পাছে বাঁধা পড়ে যাই।
বিস্মিত তুমি যতোবার টানো বন্ধন-সুতো ধ’রে,
আমি শুধু যাই দূরে।
যেদিকে ফেরাই আঁখি সর্বত্রই
তোমার নিজস্ব প্রতিকৃতি
সবখানেই তোমার চোখ
তোমার স্নেহের বাতাস।
দূরত্ব জানে শুধু একদিন খুব বেশি নিকটে ছিলাম।
সৌন্দর্য আমাকে ডেকেছিলো
প্রাচুর্য আমাকে ডেকেছিল
আমি যাইনি-
তুমি আমাকে ডাকোনি কখনো
আমি শুধু তোমারই কাছে যাবো।
তুমি প্রেমের কলিংবেল টিপে এসে দাঁড়ালে
সংশয় সন্দিহান
আমি দরোজা খুলেই সরাসরি
তোমাকে এনে বসিয়েছি হৃদয়ে।
বুকের একান্ত বেডরুমে।
আমার নিসঙ্গ ছায়া সারা পথ একাকি হাঁটে
এমন কি ভালোবাসাও
ইদানীং আমাকে আর
ভালোবাসে না।
আমি তোমার জন্য লিখি কিন্তু
তোমাকে কখনো লিখি না।
আমি যার শিয়রে রোদ্দুর এনে দেবো বোলে কথা দিয়েছিলাম
সে আঁধার ভালোবেসে রাত্রি হয়েছে ।
এখন তার কৃষ্ণ পক্ষে ইচ্ছের মেঘ
জোনাকির আলোতে স্নান করে,
অথচ আমি তাকে তাজা রোদ্দুর দিতে চেয়েছিলাম ।
বড়ো অসময়ে এসে তুমি স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাও
বড়ো অসময়ে এসে বোসে থাকো অচেতন ভুবনে।
এটা প্রস্থান নয়, বিচ্ছেদ নয়
শুধু এক শব্দহীন সবল অস্বীকার
কী ভয়ংকর এই একাকীত্ব !
কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা !
কী বেদনাময় এই বিশ্বাসহীনতা !
ভুল ভেঙে গেলে ডাক দিও,
আমি মৃত্যুর আলিঙ্গন ফেলে আত্মমগ্ন আগুন
ললাটের সৌমতায় তোমার লিখে দেবো একখানা প্রিয় নাম- ভালোবাসা ।
সন্নিধ্যে বুঝিনি ভেতরে কতটা সাগর ছিলো
কতোট ফুল ছিলো, পাখি ছিলো প্রসরিত হাতে!
আমি সেই অবহেলা , আমি সেই নতমুখ ,
নিরবে ফিরে যাওয়া অভিমান – ভেজা চোখ , আমাকে গ্রহন করো ।
তুমি যেভাবে স্বপ্ন সাজিয়ে গড়ো আপন পৃথিবী
আমার সে হাত নেই,
প্রতিবার তাই নত হয়ে আসি তোমার চোখের কাছে।
একদিন আমি আত্মার ভেতর আত্মহত্যা করলাম
অথচ কেউই করলো না শোক
শুধু – আমার ব্যক্তিগত ডায়রির
একটি পৃষ্ঠা নিশব্দে খ’সে গেল।
নিরবতা কোনো এক উদাসিন পাথরের নাম
তোমার কাছে পৌঁছাতে আমার এক যুগ কেটে গেল।
আধখানা স্বপ্নে আছি , আধখানা শ্রমে
আধখানা প্রেমে আর আধেক অপ্রেমে ।
আমরা কি কোনোদিন আর কোনো কথা বলবো না?
আমার প্রকৃত ক্যানভাসে , তোমার স্কেচ আঁকা ছিলো
অথচ তুমিই থাকোনি আমার হয়ে ।
ভালোবাসার ভিক্ষাপাত্র হাতে
উজান হাওয়ায় সুনীল সাহস মেলে
দাড়িয়ে আছি হাঁটছি একা নিরুদ্দিষ্ট
রাতের সম্মোহনে।
জীবনে যতটা প্রয়োজন আছে
ততটুকু নাও, ততটুকু রাখো
তার বেশি নয় কিছু ।
তবু ইচ্ছাকে নির্বাসন দিতে হয়
কিছু কিছু ইচ্ছাকে।
তুমি যাবতীয় দুঃখকে ছুঁড়ে দাও
আমি বুক পেতে নেবো
বুক ভাঙবেনা।